অভ্যাসবশত ছাতাটা মাথার উপর ধরা রহম আলীর। বৃষ্টির কোন সম্ভাবনা নেই। রোদও অনেকটাই হেলে পড়েছে পশ্চিম দিকে। শরতের দুপুর গড়ালে তাপ থাকেই বা কতটুকু। সবুজ মাঠের পথে নীল আকাশের সাথে আড়ি পেতে চলার পথে বাধা এই ছাতাটা। এ ধরণের বোধ অবশ্য মোটেই যায় না রহম আলী বেপারীর মতন মানুষের সাথে। অন্য কারো মাঝে এসব উপসর্গ দেখলে পাগলামী বলে খেপাতে ছাড়তো না সে। তবে আজকাল কিছুটা হলেও এমন পাগল হয়ে উঠছে সে নিজেও। তা না হলে তার হাঁটার গতি এত ধীর হবে কেন আজ? পার্টি বসে আছে বাজারে। আর সে কিনা আকাশের নীল নিয়ে ভাবছে! মেঠো পথ ছেড়ে বারবারই নজর চলে যাচ্ছে ইতিউতি। হালটে ওঠার আগে সফিজের ধানক্ষেতের আল হড়কে পড়ে গিয়ে কাদায় মাখামাখি হয়েছে একবার। সমস্যা ঐ একটাই- পথের চেয়ে বেপথে নজর। কী দরকার ছিল তার, কাঁচা ধানে মুখ দেয়া গরুটারে দাবরানী দেয়ার? যাইলে যাইতো সফিজের, তার কী? আর তার নজর তো ফসলে থাকার কথা না, তার নজর আরো গভীরে, মাটিতে। নাহ! ধাতস্থ হয়ে নিজেকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করে রহম আলী। বেশ বড় ডিল আছে আজ। নষ্ট করার মত সময় নেই। পার্টি বলে রেখেছে, কথাবার্তা পাকাপাকি করে তারা বেলাবেলাই ঢাকা ফিরে যাবে। তাড়াতাড়ির আশায় হালট ছেড়ে কোনাকুনি পথ ধরে কালামের পিঁয়াজ ক্ষেতটায় নেমে পড়ে। তিন চার খন্ড জমিতে পিঁয়াজ করেছে কালামরা কয়েক ভাই। বেশ তরতাজা সবুজ হয়ে উঠেছে চারাগুলো। গর্দান মোটা কালামের মত উদ্ধত ভাব নিয়ে মাথা নাড়ছে যেন রহম আলীর দিকে। বড় বেয়াদব এই কালামরা। সবগুলো ভাই একরোখা। গ্রামের পশ্চিমে ওদের কয়েক কানি জমি আছে। অনেক টানাটানি করেছে গত বছর। ছাড়ে নাই। বেহদ্দ চাষা রয়ে যাওয়া কিছু মানুষ! জমির মূল্য বোঝে না, বোঝে শুধু চাষবাস। জমি বেচে হতে পারে কোটিপতি, অথচ- এরা ছেঁড়া কাথায় শুয়ে এখনো স্বপ্ন দেখে পুরুষ্টু ফসলের। যৌবনবতী নারীর চেয়ে ধানশীষের দোলা অনেক বেশী কাঁপন ধরায় এদের বুকে। রাগে জ্বলে উঠতে উঠতে দপ করে আগুন নিভে যায় তার, নজর পড়ে কালামের পিঠের চকচকে ঘামের দিকে। সুখস্মৃতিরা মনের তাপ শুষে নেয় লহমায়। দক্ষিণের চকে কাবাডি খেলা, বাইচের নৌকায় দাপুটে বৈঠা বাওয়ার সময়ে পাশাপাশি কতবার দেখেছে দুরন্ত কালামের কুচকুচে পেশী আর ঘাম। আড়াআড়ি নজরে ক্লান্ত মুখটি দেখা যায়। মনযোগ দিয়ে দেখে- অনেক চিন্তার বলিরেখা সেখানে। মাত্র গেল মৌসুমে কী পরিমাণ দর গেছে পিঁয়াজের! অথচ দাদনের টাকার ফ্যাকড়ায় পড়ে লাভ পুরোটাই গেছে লগ্নিকারীর ট্যাঁকে। প্রবাসী ছেলের প্রথম কামাই এবার মাটিতে সপেছে কালাম মিয়া। ফলনটা যদি জমে ঠিকমত, দর যদি আগের বারের কাছাকাছি থাকে, অনেকটা ফাড়া কাটে বুঝি কপালের। ‘‘আহ..হা রে কালাম! ফাড়া কাটবো কেমনে! আমরা বেপারীরা আছি না? মজুদ তো থাকবো আমাগো হাতে, তর কপালে ক্ষেতি-খরচ আছে কিনা সেইটা ভাব’’- মনে মনে বলে রহম আলী। নরম মনকে ঝাড়া দিয়ে ফেলে দৃপ্ত পায়ে হেটে চলে সামনে। পিছনে পড়ে থাকে কালামদের দীর্ঘশ্বাস। আনমনে টেরই পায়নি সে কখন নিজের ক্ষেতের উপর দিয়েই যাচ্ছে। মজবুত বাধানো আল আর সিমেন্টের সীমানা পিলার তার জমির বুনিয়াদী পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আসল চেহারা কিন্তু বড়ই ক্লিষ্ট। এতিম পোলাপানের মত লিকলিকে চারাগুলো যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। ব্লক সুপারভাইজারকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে সেরা বীজ, বাজারের সেরা সার- কিন্তু ক্ষেতের চেহারা এমন কেন? মা-বাপ যদি সন্তানের দিকে নজর না দেয় হাজার মাস্টার দিয়ে বিদ্যা গিলিয়েও সন্তান মানুষ করা যায় না। কামলা গায়ে খাঁটা কাজ করে মজুরীর আশায়, মাঠ-ফসলের প্রতি কি তার সেই দরদ থাকে? সেই রকমই আমলা দিয়ে দেশ চলে না, তারা একেকটা যন্ত্র মাত্র। যন্ত্র দিয়ে কাজ চলে, স্বপ্ন দেখা যায় না। দেশটারে নিজের করে ভাবে এই রকম স্বপ্নবাজ নেতা দরকার। কার কাছে যেন শুনেছিল- কৃষক তার ক্ষেতের আইল দিয়ে হেটে গেলেও নাকি তিন ভাগের একভাগ ফলন বাড়ে। আরও শুনেছে- কৃষকের পায়ের ধুলা তার ফসলের জন্য শ্রেষ্ঠ সার। সঠিক সময়েই মনে পড়ে উচিত কথাগুলো রহম আলীর। কাত হয়ে আছে দুটো চারা। কুজো হয়ে বসে সোজা করে দিল। ধুর, জুতো পড়ে কি চাষ-বাস হয়। এমনিতেই কাদা লেগেছে আগেই, আরো মাখামাখি হয়ে গেল এবার। ছাইয়ের জুতা…গজগজ করে খুলে ফেলে সরিয়ে রাখে একপাশে। গাছের চেয়ে বড় হয়ে আছে আগাছা। অনেক দিনের অনভ্যস্ত হাতে উঠিয়ে ফেললো কয়েকটা শক্ত ঘাস। একটা ভাল অভ্যেস আছে রহম আলীর। কোন কাজে নামলে আধা রেখে ফিরে আসে না সে। পুরনো রক্তের নেশা জাগে রহম আলীর। ওর সামনে বটগাছটি এসে কথা বলে উঠলেও বুঝি এত অবাক হতো না কালাম মিয়া- রহম আলী নিড়ানিটা চাইলে এমনই চেহারা হলো কালামের। রহম আলী বেপারী নাকি করবে ক্ষেত নিড়ানী! নিজের কাজ ফেলে নিড়ানী হাতে সুবেশী রহম আলীর চাষী হওয়ার চেষ্টা ফ্যাল ফ্যাল করে দেখে। মাঠে একমনে কাজ করে চলে রহম আলী। কখন যেন ওর সাথে হাত মিলিয়েছে কালাম খন্দকার। জিরিয়ে নেয়ার ফাঁকে কালামের বাড়িয়ে দেয়া প্লাস্টিকের সস্তা গ্লাসে কলসীর ঠাণ্ডা পানিতে তৃষ্ণাও মিটিয়েছে। বেলা পড়ে আসে। এতক্ষণ কি আর বসে আছে শহরের জমি ক্রেতারা। এই আফসোসের চেয়ে দেড় শতাংশ জমি নিড়ানির শান্তিটি কম বোধ হয় না তার কাছে। তৃপ্ত মনে তাকিয়ে দেখে- কি ঝকঝক করছে ক্ষেতের এই অংশটি! এখন সবুজ চকচকে মাঠ। কদিন পরে পাকা ফসলে সোনালী হয়ে উঠবে। ফসলের চক্রে মাঠের রং বদলে আবার হলুদ রূপ নিয়ে আসবে শর্ষে। কখনো বানের পানিতে সয়লাব, কথনো শুকনো ধু ধু প্রান্তর। কিছু সময়ের জন্যে হলেও অনেক দিন পর রহম আলী প্রকৃতির নেশায় বুঁদ হয়। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ক্ষয়িষ্ণু নদী। ক্ষীণ ধারায় রসায়নের কাল অভিশাপ। নষ্ট নদীতে আর পালতোলা নৌকা নামাতে পারবে না। বয়ে যাওয়া জলস্রোত আর একটু বাড়াতে পারবে না। তবে নদীটা একবারে মরে যাওয়া থেকে এখনো বাঁচানো যায়। সবুজ খেয়ে ফেলার আগ্রাসন রোখা যায়। অবচেতন বোধে রহম আলীর বাজারে যাওয়ার আগ্রহ কমে। বাহানাও খুঁজে নেয় মন। কাদা-পানি মাখা এই শরীর নিয়ে আর যাই হোক শহুরে আধুনিক লোকজনের সাথে দর কষাকষির কাজ চলে না। নামের সাথে গ্রাম্য আদলে বেপারী যুক্ত থাকলেও কর্পোরেট কালচারে ভালই মিশে গেছে রহম আলী। কুমার নদের এই শাখাটির উপর নতুন সেতু হওয়ার পরে হু হু করে শহরায়ন আর শিল্পায়নে তার বিরাট হাত রয়েছে। সবুজ মাঠে পাথুরে দালানের পর দালান গড়ে তরল মনটারে কখন যেন জমাট করে ফেলেছিল। আজ সামান্য মাটির ছোঁয়া কোথায় যেন দোলা দিয়ে গেল। গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরছে রহম আলী আর কালাম খন্দকার। শৈশবের সুখ-স্মৃতি বেদনা সব হাজির হলো বাড়ি ফেরার সামান্য পথ চলায়। একটু সবুজ ছোঁয়ার সুখ, একটু ঘাম ঝরানো ক্লেশ অনেক দিন পর শান্তির ঘুম এনে দিলো রহম আলীকে। বাইশ বিঘা জমির ডিল, কম করে হলেও বাইশ লাখ টাকার কমিশন হতো। কোন মনস্তাপ পাত্তাই পেলো না, ব্যাঘাত ঘটাতে পারলো না তার কোটি টাকা মূল্যের শান্তির ঘুমে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
প্রজ্ঞা মৌসুমী
ইট-সুরকির সাথে সাথে মাটির দর্শন জানা। লেখনী সাবলীল এবং ধারালো গাঁথুনি। আপনি বলেছেন- 'লিখতে হলে পড়তে হয়'। সেই সাথে খেয়াল করে দেখার চোখও থাকতে হয়। পেয়াজের ক্ষেত কেমন হয় খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। এরকম লেখাই প্রত্যাশা করি; একেকটা লেখকের লেখা হবে বাউণ্ডারি হাঁকা লেখা। চ্যালেঞ্জ থাকবে, ঠিক এরকম হলে প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করার মধ্যে একটা আনন্দ আছে।
বিন আরফান.
মন্তব্য নাম্বার ওয়ান: এখন পড়ার সময় নেই হাতে অনেক কাজ. অবসর সময় পড়ব. তবে আপনার গল্প দেখে অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক আনন্দিত হয়েছিঈঈঈঈঈঈঈঈঈঈঈঈঈঈ !!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
রওশন জাহান
ইন্টুইশন পাওয়ার কিছুটা আছে আমার। অনেক সময় যা ভাবি তা মিলে যায়। কদিন আগেই ভাবছিলাম মুকুল ভাই যদি হঠাত একটা লেখা দিয়ে সবাইকে চমকে দেয় কেমন হবে। তাই হয়েছে। আপনার ফিরে আসার সাথে সাথে নিজেও ফিরে আসার তাগিদ অনুভব করছি অনেকদিন ধরে। রহম আলীদের ফিরে আসাটাই আমার মনে হয় বাস্তব।আগে হোক পরে হোক মানুষ ফিরে আসে সপ্নের কাছে।
বশির আহমেদ
দালাল রহম আলীর শুভবদ্ধির উদয় হওয়ার মধ্য দিয়ে হল্পের সমাপ্তি টানা হয়েছে । সমাজের প্রতিটি মানুষের মাছে এমন শুভ বুদ্ধির উদয় ্হউক এই কামনা রইল । ভাইজানকে অনেক দিন পর পেয়ে বেশ ভাল লাগছে ।
নাফিসা রহমান
সত্যিকারের বাংলার রূপ একেই বলে... ফসলের ক্ষেতের সাথে কৃষকের যে নাড়ির টান তা আপনি এতো সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন !! আপনার লেখনিতে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না... অনেক অনেক শুভকামনা রইল...
সূর্য
চরিত্রগুলোর নাম, পরিবেশ, শিল্পায়ন তথা শহরায়নের নামে দখলবৃত্তি, নিড়ানী বৃত্তান্ত এমন আরো অনেক কিছুই উল্লেখ করা যায় যা একজন পাঠক যে গ্রাম বাংলা এবং চাষাবাদের সাথে পরিচিত তাকে নস্টালজিক করবেই। কিছু পাঞ্চ লাইন "আমলা দিয়ে দেশ চলে না, তারা একেকটা যন্ত্র মাত্র" গল্পকারের সমাজের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতাকেই যেন দেখালো। গল্প পড়তে পড়তে আমার বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বালু নদীর দূরাবস্থাটাও ভেসে উঠলো সেই সাথে খুব কাছেই সবুজ সোনা ফলানো জমিগুলোতে গড়ে তোলা মরুভূমিগুলোও। লেখকের মেধা নিয়ে কখনোই সন্দেহ ছিল না তবে আফসোসটা থেকেই যায় তাকে নিয়মিত না পাওয়ার। এ আফসোসটা আর করতে চাই না।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।